কি যেন একটা

কি যেন একটা (জানুয়ারী ২০১৭)

নুরুন নাহার লিলিয়ান
  • ১৩
কি যেন একটা গভীর দৃষ্টি নিয়ে ও প্রায়ই আমার দিকে তাকাতো । শুরুতেই আমি বিষয়টা লক্ষ্য করেছিলাম।কিন্তু কিছু বুঝতে পারছিলাম না।সে ছিপছিপে গড়নের প্রায় পাচঁ ফুট সাত ইঞ্চির বেশ লম্বা মেয়ে। ঘাড় পর্যন্ত ঘন কালো চুল।সেই এলোমেলো চুলের ভিতর দিয়ে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাতো। ওর চাহনিটায় হিংসা, ক্রোধ, না পাওয়া,আক্রোশ আর অজানা লেলিহান আগুনের খন্ড ঝড়ে পড়তো।

আমি কোন কারন খুজেঁ পেতাম না।সম্পর্ক বলতে যা বোঝায় তা তো তখনও শুরু হয়নি। তাছাড়া সে দিনাজপুরের আর আমি বিক্রমপুরের। এর আগে কোনদিনই দেখা হয়নি। তবুও কেনো জানি বিনা কারনে মনে হলো মেয়েটি আমাকে পছন্দ করেনি। মনে মনে নিজেকে বললাম ওর মতো অগোছালো মেয়ে আমাকে পছন্দ করলেই কি আর না করলেই কি। নিজেকে বুঝালাম তাকে নিয়ে না ভেবে নিজের পড়াশুনা নিয়ে ভাবো।
তারপরও সারাদিন ক্লাস শেষে রাতের নির্জন রুমে পরস্পরমুখী বেডে দুজনেই একা। তবুও ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করতাম, " তুমি ডিনার করেছো? "
সে কঠিন ভাব নিয়ে চুলে ঢাকা মুখ আড়াল করেই বলতো, " হুম। আমি কিচেনে রান্না করে খাই।"

এটা ছিলো ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের হলে থাকার প্রথম অভিজ্ঞতা। তখনকার সময়ে আজিমপুর গোরস্থানের সাথে নতুন হল।প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার মায়ের নামে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল। আমাদের জন্য একেবারেই নতুন হল।সব কিছুই মোটামুটি সুন্দর। অন্য হল গুলো থেকে একটু আলাদা। ক্যান্টিনের খরচটা অন্য হলের চেয়ে বেশি।তাই কেউ কেউ রান্না করে খায়।
সাথেই আরেকটা পুরনো হল কুয়েত মৈত্রী হল।সামনের দিকে সমাজ কল্যান ইন্সটিটিউট। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে। এলোমেলো মনে বারান্দায় দাড়ালে অদ্ভূত ছায়ার খেলায় পুরো হলটাকে একটা পুরনো হিন্দু জমিদার বাড়ির মতো মনে হয়।দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা হলের ছাত্রীরা শুধু বন্ধুত্ব তৈরিতে ব্যস্ত।
অল্প কিছু দিনের মধ্যে আমার অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টের ছাত্রীদের সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। ক্লাস শেষে বন্ধুদের সাথে নতুন অভিজ্ঞতায় আমার বেশ সুন্দর সময় চলে যাচিছল।ক্লাস করা, ক্যান্টিনে আড্ডা দেওয়া আর বান্ধবিদের সাথে রাত জেগে হরর মুভি দেখা। ছয় সাতটা মেয়ের সাথে আমার আনন্দময় নিয়মমাফিক জীবন।

সপ্তাহের ছুটির দিনে আমি বাসায় চলে যেতাম। রুমে মাত্র আমরা দুজন। অন্য রুম মেটদের দুটো সিট তখনও ফাকাঁ । সারাদিন সে মেয়েটাও ক্লাসে থাকে। রাতেই আমাদের দেখা হয়। সে তেমন একটা কথা বলে না।তাই আমিও ওকে বিরক্ত করতাম না। ডিনার করার পর দেখতাম শরৎ সমগ্র কিংবা রবীন্দ্র রচনাবলী নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে।ওর নিশ্চুপ দীর্ঘশ্বাসের জীবনটা আমার মানবিক মনকে কেমন যেনো ছুয়েঁ যেতো।একটু একটু মায়া লাগতো।
এমন করে প্রায় কয়েক মাস গেলো। আমার যতো বন্ধুত্ব আর কথা বাইরে।রুমে গেলে আমিও পড়ার চেষ্টা করি। নয়তো নিরব সময় কাটাই। তখন মোবাইল সবার হাতে ছিলো না। বাড়ি থেকে যোগাযোগের মাধ্যম চিঠি আর অফিসের ল্যান্ড ফোন।

হঠাৎ একদিন অফিস রুমের সামনে দিয়ে তিন তলায় নিজের রুমে যাচিছ।অফিস থেকে একটা খয়েরি রংয়ের খাম আমাকে নিয়ে যেতে বলল।সেটা ঐ মেয়েটার বাসা থেকে পাঠানো চিঠি। এমন চিঠি গুলো এলে মেয়েটিকে দেখতাম আরও বেশি নির্জীব হয়ে যেতো। গভীর রাতে
ঘুমের মধ্যে ডুকরে ডুকরে কেদেঁ উঠতো।
আমার ভেতরে খুব খারাপ লাগতো। এমন একদিন রাতে। ওর কান্নায় আমার ঘুম ভেঙে গেলো। ও চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে চিৎকার করে কান্না করছে।
আমি কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখলাম। খুব ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, " কেনো এতো কষ্ট পাচ্ছো?"
সে উত্তর দেয়, " কিছু না। "

তারপর সে আরও জোরে কেদেঁ উঠে।আমি মাঝে মাঝে রাতে ওর কান্নার শব্দে ঘুমাতে পারি না। নির্বাক হয়ে ওর নিরন্তর কষ্টে ভেসে যাওয়া দেখি।
একদিন সে নিজ থেকেই জানায়। নিজ এলাকায় হোমিওচিকিৎসক বাবা আরেকটি বিয়ে করেছে। ওর একটি বড় বোন এবং একটি ছোট ভাই আছে। ওর আমার মতো আনন্দময় জীবন আর আত্মিয় স্বজন নেই। অনেক অভাব অনটন কে সঙ্গি করে ঢাকায় পড়তে এসেছে।তাই কান্না নিত্যদিনের নিয়ম।মিথ্যে করে সে সুখি হতে পারে না। কারও হাসি তাকে বিরক্ত করে। গভীর ভাবে রাগিয়ে তুলে। তার সহজ সরল স্বীকারোক্তি আমাকে অবাক করলো।

কিন্তু বাবা কেন অন্য নারীতে আসক্ত হলো? মায়ের কি কোন দোষ ছিলো?
হুম! দোষ ছিলো!
একটা শীতল চরিত্রের মাটির শরীরে সে আগুন লোকটা হিংস্র সুখ খুজেঁ পেতো না।আমি চিন্তা ভাবনায় কোথাও আটকে যাই।

সে বয়স আর বাস্তবতায় পুরো বিষয়টা আমার মস্তিষ্কে বোধগম্য হয়না। অনেক বছর পর নারী পুরুষের একান্ত রহস্যময় জগৎটা কিছুটা বুঝেছিলাম।আরে সেই ঘটনাটা মিলিয়ে নিয়েছিলাম। তবে এটা বুঝে ছিলাম। একটি সংসারে ভালোবাসা ফুরিয়ে গিয়েছিলো। একটি পরিবারে মায়া মমতার বন্ধন ছিড়ে গিয়েছিলো।
শুধু বোঝাতে চেষ্টা করলাম। ভালো করে পড়াশুনা করতে যেনো পরিবারকে সহযোগীতা করতে পারে। সে বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী। চাকরির বাজারে তার ইচ্ছে গুলো অনেকটাই অনিশ্চয়তায়।একটা তীব্র হতাশা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচিছলো।

সে আট দশটা মেয়ের মতো সবার সাথে সহজেই মিশতে পারতো না।সবার সুখি জীবন সহ্য করতে পারতো না। নিজের কাছে কাউকে যেতে দিতো না। মানুষের সংস্পর্শ কে ও সব সময় এড়িয়ে থাকতো।
সময়ের স্বার্থপরতায় আমি ও নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এর মধ্যে একটি বছর কেটে গেছে।সেই ফাকাঁ বেডে দুটো নতুন রুম মেট আসে। অল্প সময়ে তাদের সাথেও আমার একটা আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।
কিন্তু সে মেয়েটি তার নিজের মানসিক ভারসাম্যতা ঠিক রাখতে পারে না।সে রুমের কাউকেই সহ্য করতে পারতো না। সবার সাথে অসহযোগী আচরন করতো। অর্থহীন শত্রুতায় বিকৃত সুখ পেতো। ধীরে ধীরে সে সবার কাছে একটা অপ্রত্যাশিত হীন মানুষে পরিনত হল। রুমে সবার স্বাভাবিক জীবনকে সে বিষিয়ে তুললো। এক সাথে জোরে কথা বলা যাবে না। রাতে লাইট জ্বালিয়ে নিজের টেবিলেও পড়া যাবে না। সব কিছুতেই তার সমস্যা। সবাই বুঝতে পারলো গভীর বিষন্নতা রোগে সে আক্রান্ত।সবার কাছেই সে এক অপ্রিয় নাম।
একদিন হলের নিয়ম অনুযায়ী তাকে অন্য রুমে পাঠানো হলো।
তারপর ওর বিষয়টা প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততায় কিছুটা হারিয়ে গেলো। এরপর অনেক গুলো সময় হলে থাকা হলো না। গ্রীষ্মকালীন ছুটি এবং ঈদের ছুটি এক সাথে ছিলো।

হলে সেদিনের সকালটা বেশ শান্ত ছিল। আমি রুমে ফিরে ব্যাগ থেকে সব জিনিস পত্র বের করছিলাম। হঠাৎ রুম ক্লিন করতে বালতি নিয়ে হলের মিলি খালা এলো।রুম পরিস্কার করতে করতে টুকটাক কথা বার্তা হয়।

হঠাৎ সে বললো, " আপনার যে প্রথম রুম মেটটা ছিলো সে তো এখন হাসপাতালে।পাগল হইয়া গেছে। "
আমি আৎকে উঠি। পুরো বিষয়টা বিশ্বাস হচিছল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, " কি হয়েছিল? "
বিহারি খালা রুম পরিস্কার করতে করতেই বলল," রুমে বিছানার মধ্যে বটি চাকু লুকাইয়া রাখতো। সবার সাথে ঝগড়া লাগতো। "
আমি ফের জিজ্ঞেস করি, " সে সমস্যা তো একটু আগে থেকেই ছিলো। কিন্তু পাগল হলো কেমনে? "
খালা বেশ উৎসুক হয়ে বলল," আর বইলেন না। সে তার থেইকা কম বয়সি কারে জানি ভালোবাসছিল।"
আমি অবাক হয়ে শুনলাম। জিজ্ঞেস করলাম, " ভালোবাসার মানুষ কি প্রতারনা করেছিলো?
খালা বলল," হুম।মনেহয়। শেষে তো অবস্থা খুব খারাপ হইয়া গেছিল। চাকু নিয়া সে সবাইরে মারতে যাইতো। হলের সবাইরে মারার জন্য দৌড়াইতো। আমরা দড়ি দিয়া বাইন্ধা রাখছিলাম সিড়ির লগের অফিস ঘরে। "
আমি আরও স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। খালাকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম, " বাসা থেকে কেউ আসেনি? "
খালা বলল," বড় বইন মনেহয় আইছিলো। "

গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগেই একটি ছাত্রীর জীবন থেমে গেলো। পৃথিবীতে কিছু মানুষের জীবন নিরর্থক প্রাপ্তির প্রতারনায় পূর্ন থাকে।কোন কারনহীন যন্ত্রণা জীবনের সুখ স্বপ্ন কে ঢেকে রাখে। কোন ভাবেই মানুষটা তার বেচেঁ থাকার অর্থ খুজেঁ পায় না।
মেয়েটির প্রতি আমার অবশিষ্ট রাগ কিংবা বিরক্তি ব্যাখাহীন অনুতাপে রূপ নিলো। কি যেন এক গভীর মমতায় কিংবা দু:খবোধে আমার দুচোখ ঝাপসা হয়ে এলো।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মনোয়ার মোকাররম অন্য একটা সাইটে গল্পটা আগেই পড়েছি, অন্যধারা বা মহিয়সীতে... পাকা হাতে রচিত গল্প পড়লেই বুঝা যায়... শুভ কামনা ...
ভালো লাগেনি ২৯ জানুয়ারী, ২০১৭
এখানকার বিষয় ভিত্তিক লেখা গুলো এখানেই প্রথম লিখি বা প্রকাশ করি । পরে অন্য গুলোতে সময় পেলে শেয়ার করি । মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ।
সৈনিক তাপস দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে...
ভালো লাগেনি ৮ জানুয়ারী, ২০১৭
সত্যিকারের জীবনের গল্প।।
ভালো লাগেনি ৮ জানুয়ারী, ২০১৭
কাজী জাহাঙ্গীর বেশ একটা কঠিন বিষয় তুলে এনেছেন, মা’র কথা জিজ্ঞেস করার পর মেয়েটি যে উত্তর দিয়েছে সমস্যাটা আসলে ওখানেই, যেটা বুঝতে অনেক মেয়েরও কষ্ট হবে, আসলে মেয়েটা নিজেকে এবং মাকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে সে যে ছেলেটাকে ভালোবাসতো তার বয়সও মেয়েটার চেয়ে কম ছিল, সুতরাং বাবার ২য় বিয়ের ‍বিষয়টা তার অনাগত দাম্পত্যকে এক করে ফেলেছিল, অথচ ছেলেটা তার বাবার মত নাও হতে পারত, সুন্দর একটা কহিনীর জন্য অনেক শুভ কামনা সাথে ভোট,নতুন বছরের শুভেচ্ছা আর আমর পাাতায় আমন্ত্রণ।
ভালো লাগেনি ৩ জানুয়ারী, ২০১৭
আপনার পাতা নিয়মিত দেখি। শুভ কামনা রইলো।
ভালো লাগেনি ৮ জানুয়ারী, ২০১৭

০২ নভেম্বর - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ১৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪